দুরাশা গল্পের বিষয়বস্তু [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

 দুরাশা গল্পের বিষয়বস্তু

রবীন্দ্রনাথ ঠিাকুরের ‘দুরাশা’ গল্পেরা শিল্পকাঠামো বর্ণনা কর।
অথবা,   ‘দুরাশা’ গল্পের মূলভাব বা বিষয়বস্তু আলোচনা করো।

দুরাশা গল্পের বিষয়বস্তু [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন আধুনি ক ছোটািগল্পের প্রতিষ্ঠাতা । তিনি ছোটগল্পের মাধ্যমে বাঙালির আমা- আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরেছেন। ঔপনিবেশিক শাসনের এক পর্যায়ে বাংলার ‍ পল্লিগ্রাম যে দঅর্থনৈতিক গুরুত্ব অর্জন  করে এবং বুর্জোয়া মান  বতাবাদের প্রভাবে বাংলায় দেখা দেয় যে  নবতর জীবনবোধ। এই দ্বৈত প্রবণতাই সম্ভবত করেছিল ছোটগল্পাকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথে উজ্জ্বল আবির্ভাব। ‘দুরাশ’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন নারীর স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা কিভাবে দুরাশায় পরিণত হয় তার বর্ণনা দিয়েছেন। ‘দুরাশা’ গল্পটি দুজন উত্তম পুরুষের জবানিতে উপস্থাপিত হয়েছে। একজন উত্তম পুরুষ দার্জিলিং - এ আগত এবঙ দ্বিতীয় উত্তম  পুরুষ ‍গোলাম কাদের খাঁর অনাম্নী কন্যা।

‘দুরাশা’ গল্পে নারীর স্বপ্ন, আকাঙক্ষা দুরাশায় পরিণত হয়:

‘দুরাশা’ গল্পে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন নারীর  আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন  কিভাবে দুরাশায় পরিণত হয় তার বর্ণনা করেছেন। গল্পটি দুজন উত্তম পুরুষের জবানিতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। প্রথম উত্তম পুরুষ দার্জিলিংয়ে  আগত আনামা কথক েএবং দ্বিতীয় পুরুষ বদ্রাওনের নবাব গোলাম কাদের খাঁর অনাম্নী কন্যা।
দার্জিলিং - এ মেঘের কুজ্বটিকা এবং বৃষ্টিবিঘ্নিত পরিবেশে নাবাব পুত্রীকে জনমানব শূন্য ‘ক্যালকাট রোডে’ পদচাণারত প্রথম উত্তম পুরুষ বা কথক কর্তৃক আবিষ্কার, উপস্থাপিত জীবন কাহিনী শ্রবণ  এবং ধর্ম, সংস্কার ব্রাহ্মণত্ব প্রসঙ্গে প্রথম ‘আমি’র উপলব্ধি  ও মন্তব্য ‘দুরাশার’ ফ্রেমগল্প। আর নবাবপুত্রী কথিত ব্রাহ্মণ সেনাপতি  কেশরলাল সংশ্লিষ্ট আত্মজীবন  কাহিনী  ‘দুরাশা” মৌল গল্প। মৌলগল্প অংশে নবাব কন্যার ব্যথা বেদনা , হাহাকারই অধিকাংশ স্থান জুড়ে আছে । রবীন্দ্রনাত সৃষ্ট নারী চরিত্রের মেধ্যে এই নারী তার প্রেম ও সাধনার পরাকাষ্ঠায় এবং ধর্মীয় সংস্কারমুক্তির উচ্চতায় স্মরণীয়। রবীন্দ্র সৃষ্ট আলোকে সামান্য নারী সোহিনী ও কমলার বাবা প্রতিমা যে নির্মিত হয়েছে েএখানে।
বদ্রাওনের নবাবের যমুনা তীরবর্তী কেল্লায় অধিনায়ক ছিলেন আচারনিষ্ঠ তরুণ ব্রাহ্মণ কেশরলাল। নবাব হেরেম ধর্মন্ধন ছিল শিথিল। তােই স্বধর্ম সংগত উপাসনাবিধি অজ্ঞাত ছিল এই মুসলমান বালিকার। প্রতিদিন সকালে কেশরলালে যমুনাতে স্নান , সূর্য প্রণাম ও বগনগ০ান এওই বালিকার অন্তরে প্রেমের জন্ম দেয় । বালিকার প্রেম যখন গভীরতা পাচ্ছিল তখন বিচ্ছিন্ন  নাবাবদের সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা সরকার বাহাদুরের লড়াই বাধে। জাত্যাভিমানী ও স্বজাত্যনুরাগী কেশরলালের কাছে ধর্মযুদ্ধ অন্যদিকে হিন্দু মুসলমানের সম্মান  ফিরিয়ে আনার সুযোগে বলে বিবেচিত হয় । কিন্তু যুদ্ধে নিজেদের ক্ষতির কথা িভেবে সাবধানী নবাব গোলাম কাদের খাঁ কোম্পানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে করতে অনীহা প্রকাশ করেন এবং কেল্লা অক্ষত রাখতে তৎপর হন। এর ফলে সাহেবসহ লাল কুর্তি গোরা সৈন্্যরা কেল্লা অবরোধ করল।
কেশরলালের সাথে যুদ্ধে ধুলা ও বারুদের ধোঁয়য়, চিৎকার ও বন্দুকের শব্দে জল স্থল আচ্ছন্ন হলো। রক্তরাগে রঞ্জিত হলো যমুনার জল । নবাব পুত্রীর কাছে বিশ্বাসঘাতক পিতার গৃহ ও আশ্রয় নরকতুল্য মনের হলো। সন্ধ্যায় যুদ্ধক্ষেত্রে নবাবকন্যা সেনাপতি কেশরলালকে খুজে পায়, জল  পান করিয়ে আন্তরিক শুশ্রুষায় ধাতস্থ করে তোলে । কিন্তু চেতনা ফিরে পাবার পর মৃত্যুপথ যাত্রী কেশরলালের মধ্যে হিন্দুত্ব জেগে উঠে। ফলে কেশরলাল কোনোপ কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেনি। যেমন- “বেইমানের কন্যা বিধর্মী। মৃত্যুকালে যবনের জল দিয়া তুই আমার ধর্ম নষ্ট করিলি! এই বলিয়া প্রবল বলে আমার কপোল দেশে দক্ষিণ করতলে আঘাত করিলেন , আমি মূর্ছিত প্রায় হইয়া চক্ষে অন্ধকার দেখিতে লাগিলাম।
পরবর্তী সময় থেকে গল্প সমাপ্তির ঘটমান বর্তমা পর্যন্ত দীর্ঘ আটচল্লিশ বছরের  যোগিনী ও ভৈরবী দেশে নবাব দুহিতার যে জীবনযাত্রা  এ লোকায়ত বিরহিনী রাধার প্রত্নপ্রতিমাকে স্বরণ করিয়ে দেয়। নবাব দুহিতার ভাষ্য: “কেশরলালের সংবাদ আমি প্রায়ই  পাইতাম কিন্তু কোনো মতেই তাহার সাক্ষাৎ লাভ করিতে পারি নাই। ...... আমি তখন  যোগিনী সাজিয়া কাশীর শিবানন্দ স্বামী েক পিতৃ স ম্বোদন করিয়ে তাঁহার নিকট সংস্কৃত শাস্ত্র অধ্যয়ন করিতেছিলাম।’ .....গুরুর আশ্রয় ছাড়িয়া ভৈরবী বেশে আবার বাহির হিইয়া  পড়িলাম। পথে পথে তীর্থেদ তীর্থে মাঠে মন্দিরে ভ্রমণ করিয়াছি, কোথাও কেশররালের সন্ধান পাই নাই । নবাবা বন্যা ব্রাহ্মণ বেশ ধরে শেষ অবধি কেশরলালকে খুঁজে ফেরে।দীর্ঘ আটত্রিশ বছর পথ পরিক্রমা শেষে চুয়ান্ন বছরের প্রৌঢ়া লাভ করল অভাবিত অভিজ্ঞতা। দার্জিলিং - এ মেঘে ঢাকা প্রাকৃতিক গল্প বলার ্রই সকালেই সে আবিষ্কার করেছে দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত কেশরলালকে । কিন্তু সে যা প্রত্যক্ষ করে তাতে তার আত্মত্যাগী সাধনার চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। গল্পের ভাষায়, “ দেখিলাম, বৃদ্ধ কেশরলাল ভুটিয়া পল্লিতে  ভুটিয়া স্ত্রী এবং তাহার গর্ভজাত পৌত্রপৌত্রী লইয়া স্নাবস্ত্রে মলিন অঙ্গণে ভুট্টা হইতে শস্য সংগ্রহ করিতেছ।”
নাবব পুত্রী আরো বলেন, “হায় ব্রাহ্মণ, তুমি তোমার এক অভ্যাসের পরিবর্তে আর এক অব্যাস লাভ করিয়েছ, আমি আমার এক যৌবন এক জীবনের পরিবর্তে আর এক জীবন যৌবন কোথায় ফিরিয়া পাইব। “ ট্র্যাজেডি তপ্ত জীবনের  এই  আর্ত জিজ্ঞাসা নাটকীয় সাংকেতিকতায় ভরে ওঠে পরবর্তী বর্ণনায়: “ এই বলিয়া রমণী উঠিয়া গাঁড়াইয়া কহিল, ‘নমস্কার বাবুজি।” তবে এরও পরের অংশে লেখক নিজে এবং টাঠককেও দাঁড় করিয়েছেন দরাশার দোলাচলে। যেমন--‘ মুহুর্ত পরেই  েযমন সংশোধন করিয়া কহিল, সেলাম বাবু সাহেব! এই মুসলমান অভিবাদনের দ্বারা সে যেন জীর্ণ ভিত্তি ধূলিশায়ী ভগ্ন ব্রাহ্মণের নিকট শেষ বিদায় গ্রহণ করিল। আমি কোনো কথ না বলিতেই সে সেই হিমাদ্রি শিখরের  ধূসর কুজ্বটিকা রাশির মপাঝে মেঘের শেষষ মহুর্থ মিলােইয়া গেল।”
শেষ মুহুর্ত নবাবা কন্যা জীর্ণ ব্রাহ্মণের সাথে নিজের এক যৌবন জীবনের ব্যর্থসাধনার কাছেও যে শেস বিদায় নিয়ে গেল। “তার শেষ কোথায়, কি আছে শেষে।” এভাবে নাবাব কন্যার আশা দুরাশায় পর্যবসিত হয়। এরপর দীর্ঘ অভ্যস্ত জীবনের অচরিতার্থ বাসনা ও  নৈরাশ্যের কাছে এমনি বিদায় নিতে নিতে তার জীবন কাটবে কি করে?
উপসংহার: 
পরি েশষে বলা যায় যে, বশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ‘দুরাশা’ গল্পে নাবাব দুহতিার স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা দুরাশায় পরিণত হয়।  এতে নাবাব বন্যার গল্প কথনকালে কৌতূহলী শ্রোতা হিসেবে ফ্রেমে গল্পের প্রথমে   উত্তম পুরুষ স্থানে  প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ কত্ত্বেও উপান্তে কথিত গল্প এবং গল্পের নায়িকা নবাবকন্যা প্রসঙ্গে মানসকল্পনা এবং অস্বাভাবিক ‍ প্রাকৃতিক পরিবেশের পটভূমিকায় বিবৃত গল্পের  বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তার ‍ প্রশ্নবোধক দ্বিধায় কাঠামো গল্পটি পূর্ণতা পেয়ৈছে। বস্তুত নিকট অতীত  দেশকালের রোমান্সতুল্য আলোকস্মপাতে গল্পখানি বর্ণিল হয়ে উঠলেও অভ্যন্তরীণ সম্প্রদায় নিরপেক্ষ মানবিক প্রেমের একনিষ্ঠা প্রস্তুত করেছে ‘দুরাশা ‘; গল্পের প্রাতিস্বিক মূল্য।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post