পোস্টমাষ্টার অথবা, সমাপ্তি গল্পের সমালোচনা লেখ।

পোস্টমাষ্টার অথবা, সমাপ্তি গল্পের সমালোচনা লেখ।

অথবা, পোস্টমাস্টার অথবা, সমাপ্তি গল্পের যুক্তিনিষ্ঠ সমালোচনা কর।

পোস্টমাষ্টার অথবা, সমাপ্তি গল্পের সমালোচনা লেখ।


উত্তরঃ বাংলা সাহিত্যের সকল শাখায় যিনি সার্থক পদচারণ করেছেন তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কাব্য রচনার জন্য তিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেটি তার হাতের স্পর্শে সমৃদ্ধ ও সার্থক হয়ে ওঠেনি। বাংলা সাহিত্যেল নবীনতম শাখা ছোটগল্পের জনক তিনি।তাঁর হাত ধরে সাহিত্যের এ শাখাটি সমৃদ্ধির উচ্চ শিখরে আরোহণ করেছে। তার শতাধিক গল্পের সংকলন গল্পগুচ্ছ। এ গল্প গ্রন্হের প্রতিটি গল্পে তিনি আমাদের চিরপরিচিত জগৎ ও জীবনের ছবি অঙ্কন করেছেন। এ গ্রন্হের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প পোস্টমাস্টার ও সমাপ্তি।

পোস্টমাষ্টার অথবা, সমাপ্তি গল্পের সমালোচনা লেখ।

নিম্মে ’পোস্টমাষ্টার গল্পের সমালোচনা প্রদান করা হলো- ‘পোস্টমাষ্টর’ গল্পটি দুটি মানব-মানবীর প্রেমের গল্প। এতে তুলে ধরা হয়েছে গ্রামীণ জীবনের দুঃখসহ একঘেঁয়েমিতে ক্লান্ত শহরে পোষ্টমাস্টার মশাই একদিন তার চাকরির বদলি চেয়েছিলেন- যদি তার সে ইচ্ছা পূরণ না হয় তাহলে যে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দিতেও প্রস্তুত, সেকথাও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেই তথাটুকুকে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে পরিবশন করেছেন তাতে পোস্টমাস্টারের প্রস্তার যেমন আছে তেমনি আছে মানবজীবন রস। সেই পঞ্জীবনী সুধার স্পর্শে এই নিতন্ত কোজো অভিযোগ এমন হৃদয়স্পর্শকারী অনুভূতি জাগাতে পেরেছে। গল্পের শেষে সে অনুভূতি কেবল গল্পের প্রধান নারী রতনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি তা ক্ষণিকের জন্য হলেও এড়িয়ে দিয়ে গেছে তরুণ পোস্টমাস্টারের মনের গহীনে।

এই গল্পের স্পর্শকে আছোচনা করতে গিয়ে দেখা যায় প্রকৃত অর্থে এই গল্পের কোনো জমকালো ঘটনা নেই। কলকাতা থেকে এক শহরে যুবকের চাকরির উদ্দেশ্য উলাপুর গ্রামে আগমন। অতঃপর সেখানে তার কিছুদিন থাকা এবং ম্যালেরিয়া রোগে অসুস্হ হয়ে পড়া এবং সুস্হ হয়ে পরে সেখান থেকে ফিরে যাওয়া। জনসংযোগের উৎকৃষ্টস্হল যে পোস্ট অফিস সেখানে সেখানে কোনো মানুষের উপস্হিতিই মনকে জাগিয়ে তোলে না। গল্পের নায়ক পোস্টমাস্টার। এই নামেই সে পরিচিত। তার অন্য কোনো নাম নেই। বৃওিতে, জীবকাতে তার পরিচয়। জীবিকার প্রয়োজনে তার শহর কলকাতা ছেড়ে এই উলাপুরের গন্ডগ্রামে আসা। এখানে এসেই ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো সে অসহায় এবং আধমরা। গ্রামীণ পোস্ট অফিসের কাজ, স্বাভাবিকভাবেই কাজ নেই-ই প্রায়। দিনের দীর্ঘ সময় কাটানো বড়ো বালাই।

পোস্টমাস্টার সময় পার করার জন্য পুরানো নেশা, কবিতার দ্বারস্হ হয় এবং কবিতা লেখে। নিত্যন্ত শখেল কবিতা। গাছপালা, নদী-নালার প্রতি তার ভঅলোবাসার রক্ষরাগ পূর্বের কবিতায় ঝরেছে- কিন্তু গ্রামে সেই প্রকৃতির বুকে এসে তার সব ধরনের অনুভূতি যেন বিমর্ষ হয়ে পড়ে। শহরে ফিরে যাবার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মনে পড়ে মা, দিদি, আর ভাইয়ের কথা। রতনের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় তার অন্তরের সেসেব আড়ালে থাকা কথা প্রকাশ হয়ে যেত ‘এক-একদিন সন্ধ্যাবেলায় সেই বৃহৎ আটচালার কোণে আপিসের কাঠের চৌকির উপর বসিয়া পোস্টমাস্টারও নিজের ঘরের কথা পাড়িতেন ছোটো ভাই, মা এবং দিদির কথা প্রথমে একলা ঘরে বসিয়া যাহাদের জন্য হৃদয় ব্যথিত হইয়া উচিত তাহাদের কথা।’’

এভাবে করে পোস্টমাস্টার তার পিছনে ফেলে আসা দিনগুলির কথা মনে করতে লাগলো। আর উলাপুরে এসে তার সাথে দেখা হয় গ্রামের পিতৃ-মাতৃহীনা রতনের সাথে। আর এই রতনই হয়ে উঠেছিল তার নিঃসঙ্গ নির্জন প্রবাসের একমাএ বিশ্বস্ত সঙ্গী। গোমস্তা  বা অন্যদের সঙ্গে কথা বলা তার মতো সামান্য চাকুরের পক্ষে ছিল অতি কঠিন। পল্লিবাংলার অস্বাস্হ্যকর পরিবেশ বর্ষা আসে। সে বর্ষায় মানুষকৈ মত্ত করে, বিরক্ত করে। আর ম্যালেরিয়ার আক্তান্ত হয় গ্রামের এই পোস্টার। যে গ্রামকে ভালো লাগছিল তার কবিতায়, ধীরে ধীরে ভালো লাগছিল অন্যত্রও, এখন যার কারণে সময় কাটানোর জন্য রতনকে লেখাপড়া শেখানের চেষ্টা ছিল তার- সেই সব কিছুই যেন আবার বিশ্বাদ হয়ে গেল তার কাছে। রতনের অহোরাত্রি সেবায় সুস্হ হয়ে উঠলো সে। তবে দীর্ঘকাল ধরে তার এই অসুস্হতা মনকে একেবারে ভেঙে দিল- ‘মনে স্হির করিলেন, আর নয়, এখান হইতে কোনোমতে বদলি হইতে হইবে।’’

বদলির দরখাস্ত করে দিয়েই পোস্টমাস্টারের মন যেন গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দিয়েছিল। তাই রতন তার বইপত্রসহ পোস্টমাস্টারের ডাকের প্রতীক্ষায় দ্বারের বাইরে বসে থাকলেও আপনাতে আপনি নিমগ্ন হয়ে থাকা পোস্টমাস্টার সে ডাকে সাড়া দেবার কথাই যেন বিস্মৃত হয়ে যায়। বেশ কিছুদিন চলে এই নিঃশব্দ দূরত্ব-এই অদৃশ্য আড়াল, এরপর একদিন সে রতনকে ডেকে জানিয়ে দেয় কোলকাতায় তার বাড়িতে ফিরে যাবার কথ। জানিয়ে দেয় তার বদলির দরখাস্ত নামঞ্জুর হয়েছে বলে নিজেই থেকেই চাকরি ছেড়ে ফিরে যাচ্ছে সে তার বাড়িতে। লক্ষণীয় সূস্হতার পর থেকে পোস্টমাস্টারের অন্তরে যে আলোড়ন জেগেছিল-তার দরখাস্ত করা, আবেদন নামঞ্জুর হওয়া, চাকরি ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া, নতুন পোস্টমাস্টারের আগমনের কথা জানা এবং জানানো ইত্যাদি ঘটায় তার সমাপ্তি ঘটেছে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে চাকরি ছাড়ার। আর সেই কারণেই এই কদিন তার পক্ষে রতনের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলা সম্ভব হয়নি। মনের গভীরে আশা নিরাশার দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে বিধ্বস্ত ও চাকরি ছেড়ে যাবার জন্য বেদর্নাত পোস্টমাস্টার অনেক কষ্টে তার সঙ্গীকে প্রথম জানায়, ‘’রতন, কালই আমি যাচ্ছি।’’

আরো পড়ুন - 

পোস্টমাস্টারের মানবিক মুখের রূপ দেখা যায় রতনের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ। যাবার আগে রতনের হাতে কিছু টাকা দিতে গিয়েছে সে এবং তাকে আশ্বাস দিয়েছে নতুন পোস্টমাস্টারকে। কিন্তু এক গ্রামীণ কিশোরীর অন্তরের ক্ষোভ-বিক্ষোভ মান-অভিমান নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় নেই বাড়িমুখো পোস্টমাস্টারের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বর্ষা বিস্ফোরিত নদীতে নৌকায় উঠে বসেছে সে। আর এ সময়ই নদীর এই তরঙ্গের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়েছে একটা গ্রাম্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মকথা ব্যক্ত করে চলেছে। রতনের অন্তরের গভীর গোপন কথা পোস্টমাস্টারের মনে এক মুহূর্তের যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মকথা ব্যক্ত করে চলেছে। রতনের অন্তরের গভীর গোপন কথা পোস্টমাস্টারের মনে এক মুহূর্তের জন্য নাড়া দিল। তার রতনের প্রতি সমবেদনা জাগলো্ সে ভাবলো ‘’ফিরিয়া যাই জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি।’’

কিন্তু পোস্টমাস্টারের এ যন্ত্রণা ক্ষণিকের । কেননা নদীর এই শ্রোতধারা, গ্রামের শেষের শ্মশান- তার মনে চিরপ্রবহমান জীবনধারার কথাই জাগিয়ে দেয়। মনে হয় জগতে সবকিছূই তো চলে যায়- মিলনের আনন্দ মুহূর্তে বিচ্ছেদের বেদনাময় অনুভবে বিলীন হয়ে যায়। গভীর দার্শনিক তত্ত্ব কথা জাগে তার মনে- আচায শঙ্করের  ‘মোহমুদগর তত্ব- কা তব কান্তা কন্তেপুত্র। ভাবলো ‘পৃথিবীতে কে কাহার।’

গল্পশেষে লেখক জীবনের আশ্চয ইঙ্গিত নিয়েছেন। মানবসঙ্গ ব্যাকুলতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এই ব্যাকুলতাই এই গল্পের মূল বক্তব্য। অন্তিম মন্তব্যে তারই স্বীকৃতি-’’হায় বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়। ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহু বিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্র্রবল প্রমাণকেও অবিশ্বাস করিয়া মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভিতরে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ী কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে।’’

পোস্টমাস্টার একটি নিটোল ত্রুটিহীন ছোটগল্প যাকে রবীন্দ্রনাথ মুক্তোর মতো নির্মাণ করেছেন, যার পায়ে দুফোটা রক্তবিন্দু উজ্জ্বল হয়ে আছে।

সুতরাং সার্বিক আলোচনার পরিশেষে বলা যায় যে, পোস্টমা্স্টার গল্পটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক অসাধারণ সৃষ্টি। এত বর্ণিত হয়েছে দুটি দুঃখ ভরা ভাবক্লিষ্ট মনের অভিপ্রায়। জীবন মৃত্যুর চির রহস্য। মিলন বিচ্ছেদের চিরন্তন কখা গল্পের শেষে বলায় নীতিবাক্যের ভাবনা যেন বড়ো হয়ে উঠেছে। পোস্টমাস্টারের হৃদয়ে জেগে ওঠা ভাব তরঙ্গ আর রতনের মনে রতনের মনে জেগে থাকা আশার শেষ তরঙ্গ মিলবার কোনো উপায় আর না পেয়ে শেষ না হয়েও গল্প যেন শেষ হয়ে গেছে ভবিতব্যের বিধানে। এভাবেই গল্পের আলোচনা-সমালোচনা এসেছে।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post