রক্তকরবী নাটকের নামকরণের সার্থকতা
অথবা,
৩রূপক নাটক কী? রূপক নাটক হিসেবে ‘রক্তকরবী’ নাটকের সার্থকতা বিচার কর।
অথবা, রূপক নাটক কী? রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ রূপক হিসেবে কতটুকু সফল আলোচনা কর।
প্রতিটি রচনার ক্ষেত্রে লেখক বা সাহিত্যিক একটি নিয়ম বা কৌশল ব্যবহার করেন, তেমনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর ১৯২৬ সালে প্রকাশিত ‘রক্তকরবী’ নাটকটি রচনার ক্ষেত্রে রূপক পদ্ধতিটি ব্যবহার করেছেন। ‘রক্তকরবী’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত রূপক নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি নাটক।
§ রূপক নাটকঃ ইংরেজি Allegory অর্থ রূপক। যে নাটকের মধ্যে কোনো নীতিগর্ভ কাহিনি থাকে সেই
কাহিনীকে যথেষ্টে সরলতার সঙ্গে প্রকাশ করা হয়, অর্থাৎ মর্মাংশে আরেকটি অর্থ সমান্তরাল রেখায় বিধৃত থাকে তাকে নাটক বলে। এর মধ্যে বাহিরে প্রতীয়মান একটি বিষয় থাকে আর ভিতরের অন্য একটি বিষয়েরে বহিঃপ্রকাশ ঘটে। রূপক নাটকের রস সাধারণ রস ন, ভাবানুভূতিজনিত এক প্রকার বিশেষ আনন্দই তার আত্মা। নাটকের চরত্রি এক একটা ভাবাদর্শের প্রতীক। মূলত বাস্তবের সাহায্যে অবাস্তবকে রূপায়িত করার চেষ্টা হতেই রূপকের জন্ম।
§ রূপক নাটক হিসেবে ‘রক্তকরবী’ নাটকের সার্থকতাঃ নাট্যকার বলেছেন, ঘটে যাহা সব সত্য নহে। অর্থা্য বস্তু সত্য নয় ভাব সত্য। এই ভাবসত্যকে নাট্যকার যে রূপের আশ্রয়ে উপস্থাপিত করেছেন তা প্রকৃত বাস্তবরূপের মযাদা লাভ করেনি, রবং সংকেতটুকুর মধ্যে তার সম্ভাবনা আবদ্ধ হয়ে আছে।
রূপক আচ্ছন্ন করে ভাবেরই প্রধান হয়ে পড়া এবং রূপকে নাটকের এই প্রধান লক্ষণটি রক্তকরবীর সর্বাঙ্গে প্রস্ফুটিত। অধিকস্ত রূপক নাটকের যে ধরনের কুহেলিকা প্রতীয়মান হয় এখানেও চরিত্রগুলো সে রূপ ছায়ায় আচ্ছন্ন। নন্দিনীকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবীর ছবিরূপে দেখাতে অসম্ভব হননি। রক্তকরবী নাটকে ভাবসর, রচনারস ছাড়াও হুদয়রস আছে কিনা দেখতে নন্দিনী চরিত্র বিচার করতে হবে। নন্দিনী কিশোরের দুঃখ সইতে পারে না, রাজার বিশ্রী জালটা ছিঁড়ে ফেলে মানুষটাকে উদ্ধার করতে তার ইচ্ছে জাগে, সে কোনো বাধা মানতে চায় না। অন্যদিকে, রঞ্জনের সাথে তার প্রাণের যোগ। বিশেষ করে প্রাণের স্পর্শ দিয়েছিল কেবল রঞ্জনকে। তাই রঞ্জনের মৃত্যুকে নন্দিনীর মনে বিচ্ছেদের বেদনা অনুভূতিতে আচ্ছন্ন দেখা যায়। বিচ্ছেদ বেদনায় আকুল হয়ে নন্দিনি বলেছেন, তবে আমাকে ও ঘুমেই ঘুম পাড়াও। আমি সইতে পারছি নে। বিচ্ছেদ বেদনা ও ভাব সম্মিলনের আকাঙ্ক্ষাকার দ্বারা শেষ পযন্ত আচ্ছন্ন হয়ে গেলেও করুণ মূর্ছনার রেশ শেষ পযন্ত্ই পাওয়া যায়।নাটকে নন্দিনী সৌন্দয, প্রেম, মুক্তি, আনন্দস্বরূপ রূপে রূপায়িত, তাই নন্দিনী যার স্বরূপ রক্তকরবী নাটক তারই প্রতীক। মূলত রক্তকরবী ও নন্দিনী একই অস্তিবান। দেহ তার অর্থর্নিহিত ভাবকে সংকেতরূপে ধারণ করেছে। রাজার মূল্য এখানে রাজশক্তি শাসনযন্ত্রের মধ্যে দিয়ে অভিব্যক্তি। শাসক এখানে যন্ত্রস্বরূপ সে সর্বদা রাজ্যের অন্তর্নিহিত ও বাহ্যিক অবস্থান নিয়ে মগ্ন।
এখানে ব্যক্তি মানসিকতার চেয়ে ক্ষমতার বেশি মূল্যায়ন করা হয়েছে। তাই রাজা এখানের প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। রঞ্জনের মনের যৌবন অন্তরাত্নার চির সম্পদ, প্রাণের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ। রঞ্জন মরেও নন্দিনী মনের মাঝে চির অমর হয়ে রয়েছে। তার মৃত্যুতে নন্দিনীর বুকের ভিতর রক্থ আর রক্তকরবীর গুচ্ছ ফুল একসাথে উজ্জ্বল লাল আভায় যক্ষপুরীর বুকে অম্লান দীপ্তিতে শোভা ফেলেছে। রূপকে এই অংশগুলো এমন মননশীলতা ও সার্থকতায় নির্মিতি যে সমান্তরাল অর্থ তাৎপয ও বাস্তবের একটা সুসংগত ছবির আমাদের কল্পনায় ভেসে উঠে। অর্থাৎ রূপক নাটকের যে সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে তার প্রায় সবই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ নাটকে রয়েছে। তাই নাট্যকার যদিও রক্তকরবী নাটকটিকে রূপক হিসেবে প্রকাশে ইচ্ছুক নয়, কিন্তু সবদিক বিশ্লেষণ করে অনেকাংশ ‘রক্তকরবী’ নাটকটিকে রূপক নাটক হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ‘রক্তকরবী’ নাটকটির কাহিনি, সংস্থাপন কৌশল রীতি, চরিএচিএন ইত্যাদি দিক দিয়ে এটি একটি রূপক নাটক।
‘রক্তকরবী’ নাটকের সাংগঠনিক বৈশিষ্ঠ্য বা গঠনকৌশল আলোচনা কর।
অথবা,
’রক্তকরবী’ নাটকের শিল্পসার্থকতা বিচার কর।
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের ‘রক্তকরণী’ নাটকটি
রচনার ক্ষেত্রে তিনি
সমাজব্যবস্থার শোষক ও
শোষিতের দ্বন্দ্ব, মালিক
ও প্রজার মধ্যে
বিভেদ, পরমশ্রমজীবীর সাথে
পরিশ্রমজীবীর দ্বন্দ্বের স্বরূপকে
কেন্দ্র করে বিভিন্ন
গঠনকৌশল ব্যবহার করেছেন।যা নিম্মে বিশ্লেষণ
করা হলোঃ
§ রক্তকরবী’র
মুল কাহিন:ঃ
মূলত ‘রক্তকরবী’ একটি
ফুলের নাম। যক্ষপুরীর রাজা
ছিলেন অত্যন্ত
আরো পড়ুন -
শক্তিশালী
এবং অনেক ধন-সম্পদ ও শক্তির
অধিকারী কিন্তু সে
শক্তি ছিল শুধু
বাহিরে।
ভিতরে ভিতরে রাজার
ছিল একাকিত্ব, সে
রাজ্য জয়ের মতো
করে নন্দিনীর মনকে
জয় করতে চায়। খোদাই
করা পাথরের পাতাল
থেকে স্বর্ণ উত্তোলন
করে রাজভান্ডার পূর্ণ
করে তোলে। বাইরের পৃথিবীর
সাথে তাদের সম্পর্ক
বিচ্ছিন্ন।
এমন সময় রাজ্যে
আসে নন্দিনী যার
মাধ্যমে রাজা খুঁজে
পায় নিজের সত্তাকে
ও মুক্তির পথ। রাজাকে
আবরণের জাল থেকে
বের করে নিয়ে
আসে নন্দিনী। কিশোর মজুর
নন্দিনীর জন্য ‘রক্তকরবী’ ফুল নিয়ে আসে। অধ্যাপক
নন্দিনীর সাথে কথা
বলে আত্মতৃপ্তি পায়
তাই সে পুথিঁ
পড়ার ফাকে এসে
নন্দির সাথে কথা
বলে।
বিশু, খাপছাড়া কথা
বলতে সকলে তাকে
পাগল বলে। কিন্তু নন্দিনী
তার জন্য প্রতিবাদ
করে।
তাকে সহায়তা জন্য
নন্দিনী বিপ্লব করতে
চায়।
রঞ্জনের মৃতদেহ দেখে
প্রতিক্রিয়া দেখায়।অর্থা্ৎ নাটকের
নাম রক্তকরবী হওয়া
যথার্থ।
§ চরিত্র গঠনের কৌশলঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রতিটি চরিত্র গঠনের
ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব
দিয়েছেন এবং ঘটনা, অবস্থান
বিশ্লেষণের জন্য যে
সকল চরিত্র সৃষ্টি
করেছেন তা হলো- রাজা, সর্দার, গোসাই, অধ্যাপক, পুরাণবাগিশ, মোড়ল, রঞ্জন, বিশু, নন্দিনী, ফাগুলাল, কিশোর, পালোয়ান, গোকুল, চন্দ্রা
প্রভৃতি চরিত্র। এখানে নাট্যকার
নন্দিনীর চরিত্রটি শাসক
শ্রেণি ও শোষিত
শ্রেণির মধ্যবর্তী রেখেছেন। দুইদিকে
তার প্রভাব প্রকাশ
পেয়েছে।
নাটকের গুরুত্বপূর্ণ অংশ
জুড়ে নন্দিনীর বিচরণ
এবং পরিশেষে রঞ্জনের
মৃত্যুর মধ্য দিয়ে
পাঠকের হুদয়ে তার
অবস্হান বিয়োগান্তক স্থান
পেয়েছে।
অন্যদিকে রাজা নন্দিনীকে
নিজের করে জয়
করতে চেয়েছিলেন কিন্তু
নন্দিনী তাকে উপেক্ষা
করে।
তার হাতে রয়েছে
নন্দিনীর দেয়া ‘রক্তকরবী’। এটা
দেখে রাজার বিবেক
জেগে ওঠে সে
মুক্তজীবনের মর্ম উপলদ্ধি
করেন।
নন্দিনীও শেষমুক্তির পথে
বেরিয়ে যায়।
রক্তকরবী
নাটকের শিল্পকৌশলঃ শিল্পকৌশল
শিল্পীকবি ভাস্কর সৃষ্টির
আনন্দময় মুহূর্ত। নাট্যকার তার
রক্তকরবী নাটকে দুঞ্গেয়, দুরুহ
এবং অজানা অদৃশ্যকে
ভাষায় রূপ দেওয়া
মানুষের সাধ্যতীতে অজানাকে
শিল্পকর্মের মাধ্যমে রূপায়িত
করে।
উপমা অলংকার, রূপক
ও সাংকেতিকতার মাধ্যমে
বিভিন্ন চরিত্র সৃষ্টির
মাধ্যমে তার শিল্পকৌশলে
পরিপূর্ণতা দিয়েছেন। এখানে নন্দিনীকে
রক্তকরবীর প্রতীকরূপে, মানবকন্যা, প্রাণের
সৌন্দয, প্রেমের শক্তিরূপে
প্রকাশ করেছে। রক্তকরবী পুষ্পকে
নন্দিনী প্রতীকরূপে উপস্থাপন
করা হয়েছে। রক্তকরবী যা
নন্দিনীও তাই।
রাজার
রাজ্য ক্ষমতা সম্পদ
শক্তি সবকিছু আছে
তারপরেও সে জীবন
থেকে প্রকৃতি থেকে
বিচ্ছিন্ন।
তাই তো রাজা
বলেন, ‘’আমি পর্বতের
চূড়ার মতো, শূন্যতাই
আমার শোভা।’’ এখানে রাজার
একাকিত্বের প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া
অন্য চরিত্রগুলোর মধ্যে
জীবন আদর্শের বহমান
চলক সংঘাতগুলো বিদ্যমান
এবং যক্ষপুরী রাজার
সাথে শোষণ ও
ক্রিয়া প্রতিঘাত রূপ
রূপান্তিত।
ভাষা ব্যবহারঃ
যেকোনো সাহিত্যে
সৃষ্টি কর্মকে সুন্দর
করার মূলে রয়েছে
ভাষার ব্যবহার। সঠিক সংলাপ
প্রয়োগের মাধ্যমে রচনাটি
পাঠকের মনে আকর্ষনীয়
ও বোধগম্য হয়। রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর তাঁর ‘রক্তকরবী’ নাটকে
ভাষার সঠিক ব্যবহার
করেছেন কর্ম, চরিত্র, অবস্থান
ভেদে।
যথা- রাজা নন্দিনীকে
উদ্দেশ্য করে উক্তিটি
প্রকাশ করেছিলেন,
‘’আমি প্রকান্ড
মরুভূমি তোমার মতো
একটি ছোট্র ঘাসের
দিকে হাত বাড়িয়ে
বলছি, আমি তপ্ত, আমি রিক্ত, আমি
ক্লান্ত ।’’এছাড়াও
অধ্যাপক নন্দিনীকে উদ্দেশ্য
করে উক্তিটি ব্যক্ত
করেছিলেন, “ওগো রক্তকরবী, আমাদের
মাটির তলাকার খবর
নিতে এসো না, উপরের
হাওয়ার দোল দেখবো
বলে তাকিয়ে আছি।’’
’রক্তকরব, নাটকে
অনেকগুলো অলঙ্কার ব্যবহার
করা হয়েছে। যথা-রূপক, উপমা, প্রতীক, চিত্রকল্প, সমাসোক্তি
ইত্যাদি।
নিম্মে কিছু অলঙ্কারের
উল্লেখ করা হলো- ‘’জলের
ভিতরকার হাল যেমন
আকাশের উপরকার পালাকে
ভালোবাসে, পালে লাগে
বাতাসের গান, আর
হালে জাগে ঢেউয়ের
নাচ।’’
উপসংহারঃ
পরিশেষে বলা যায়
যে, ‘’রক্তকরবী’নাটকের
নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত
দক্ষতার সাথে নাটকের
গঠনকৌশল প্রয়োগ করেছেন। তাই ‘রক্তকরবী’ নাটকটি
শিল্প ও গঠন
কৌশলে দিক থেকে
সার্থক নাটক।
পুঁজিবাদী সভ্যতার সমালোচনা হিসেবে ‘রক্তকরবী’ নাটকের তাৎপয বিশ্লেষন কর।
নাটক
হলো নানান বিষয়
সম্মদ্ধে ব্যক্তির ব্যাপ্তিমান
জীবন কথারিই প্রত্যক্ষ
রূপায়ন।
এই রূপমা্ত্রই দেশ-কালোর সীমায় আবদ্ধ
হতে বাধ্য হয়
বটে।
সেদিক বিচারে প্রত্যেক
রূপেরই দেশ-কাল
সাপেক্ষতাজনিক এক ধরনের
ভাবগত ব্যস্তবতাও আছে। কিন্তু
বাস্তবতা বলতে আমরা
সেই দেশ-কালের
সাপেক্ষতাই বুঝি, যে
দেশ-কাল কল্পিত
নয়-অন্তত বিশ্বাসের
মশুলে যার সত্তা
সুবিদিত।
নাটক বলতে আমরা
এরূপ দেশ-কাল
সাপেক্ষ জীবনেরই রূপায়ন
বুঝি।
কিন্তু ‘রক্তকরবী, নাটকে
রূপায়িত হয়েছে এক
ধনিক শ্রেণির চিত্র, যেখানে
ধনিক সম্প্রদায় সাধারণ
মানুষকে শোষণ করে
থাকে।
সাধারণ মানুষের নিজস্ব
অধিকার বলতে কোনো
কিছু থাকবে না। পুঁজিবাদীদের
অধীনে তারা কাজ
করবে।
নিম্মে প্রশ্নালোকে আলোচনা
প্রদান করা হলো-
§ ‘রক্তকরবী’ নাটকের
তাৎপযঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ নাটকে
দেখা যায় পুঁজিবাদী
সমাজতন্ত্র ও সাধারণ
জনগণের মধ্যে একধরনের
দ্বন্ব্বের স্বরূপ। তাছাড়া এই
নাটকে-
‘’রাজা একটা
জটিল জালের আবরণে
বাস করে। এই জাল
হচ্ছে রাজার নিত্যমুক্ত, সর্বপ্রসারী
আনন্দময় স্বরূপের বাধা। বাধার
স্বরূপে হচ্ছে বস্ততন্ত্রের
নিরেট সাধনা, বৈজ্ঞানিক
জ্ঞানের দ্বারা অপযাপ্ত
শক্তিবীজ ও প্রভৃত
ঐশ্বয সম্ভোগ; মনুষ্যত্বহীন, হৃদয়হীন, সঞ্চয়কামী, শোষণশীল
সমাজ ও যান্ত্রিক
ব্যবস্থার প্রভাব, আনন্দহীন
বন্ধ জীবন। এটাই রাজার
অন্তরতম মুক্ত আনন্দময়
সত্তাকে আবৃত্ত করে
রেখেছে।’’
’নন্দিনীর
কাজ জালের মধ্যে
ঢুকে রাজাকে জালের
আড়াল হতে বের
করে আনা। সে জালের
দরজায় যা দিয়ে
বলে- ‘’আজ খুশিতে
দুলবে।
জাল খুলে দাও, ভিতরে
যাব।’’ রাজা
বলে- ‘’না, ঘরের
মধ্যে নয়, আসতে
দেব না, কী
বলবে শীঘ্র বলো, আমার
সময় নেই, একটুও
না।’’
বৃহত্তর
জীবনের আবেদনে সাড়া
দিতে তার বদ্ধ
জীবনের প্রতি স্বভাবতই
অনিচ্ছ ও ভয়-তাই সেই শূন্য
জীবনকেই আঁকড়িয়ে ধরে
থাকবার ইচ্ছাতে সে
নিজেকে ব্যাপৃত রাখতে
চায়- অনভ্যস্ত আনন্দকে
ভয় করে। নন্দিনী প্রকৃতির
সৌন্দযের দিকে তার
মনকে আকৃষ্ট করতে
চায়, পৌষের সোনা
ছড়ানো রোদ্দুরে পাকা
ধানের লাবণ্য দেখাবার
জন্য মাঠে নিয়ে
যেতে চায়। সৌন্দযকে তো
হাতের মুঠোর মধ্যে
ধরা যায় না, তাকে
পাওয়া যায় অন্তরের
আনন্দময় উপলদ্ধির মধ্যে। রাজার
বস্তসর্বস্ব জড়বাদী মন
তাতে সাড়া দেয়
না, বলে- ‘আমি
মাঠে যাব, কোন
কাজে লাগব।’ রাজার কাছে
কাজের অর্থ প্রয়োজনের
ফল, আর পাওয়ার
অর্থ বস্তরূপে পাওয়া। তার জীবনে প্রয়াজনহীন
অকাজ নেই, খেলা
নেই, হৃদয় দিয়ে
কোনো বস্তু গ্রহণ
নেই।
নন্দিনী
রাজার অদ্ভুত শক্তির
প্রশংসা করে। সেই শক্তির
অভিনন্দনের প্রতীকস্বরূপে কুন্দ ফুলের
মালা তার গলায়
পরাতে চায়। শক্তিই প্রাণকে
ধারণ করে, জীবনকে
বহন করে, তাই
নন্দিনী শক্তিকে শ্রদ্ধা
করে, শক্তিতে আনন্দিত
হয়।
নন্দিনী বলে যে-যে বিপুল শক্তি
দিয়ে অনায়াসে তাল
তাল সোনা দিয়ে
চুড়ো করে সাজাচ্ছিলে, তাই দেখে সে
মুগ্ধ হয়েছিল, কিন্তু
ধরনীর সাথে সহজ
আনন্দে যুক্ত না
হলে এ শক্তি
সার্থক হয় না। তাই সে রাজাকে
আলোতে বেরিয়ে এসে
মাটির উপর পা
দিতে বলে।
রাজার
ভেতরে ইচ্ছে আছে, কিন্তু
সে ব্যর্থ হয়ে
নন্দিনীকে বলেছে- ‘’তোমাকে
তোমার রূপের মায়ার
আড়াল থেকে ছিনিয়ে
আমার মুঠোর মধ্যে
পেতে চাচ্ছি, কিছুতেই
ধরতে পারছিনে।’’
পৃথিবীর
নিচের তলায় পিন্ডু
পিন্ডু পাথর, লোহা, সোনা- সেখানে
রয়েছে জোরের মূর্তি। উপরের
তলায় একটুখানি কাঁচা
মাটিতে ঘাস উঠছে, ফুল ফুটছে-সেখানে
রয়েছে জাদুর খেলা। দুর্গম
স্থান থেকে সে
হিরে আনে, মানিক
আনে, সহজের থেকে
ওই প্রান্তের জাদুটুকু
কেড়ে আনতে পারে
না।
রাজার
যা আছে সব
বোঝা হয়ে আছে। সোনা
জমিয়ে তো পরশমণি
হয় না- শক্তি
যতোই থাক তা
যৌবনে পৌছে না। তাই পাহারা বসিয়ে
নন্দিনীকে বাঁধতে চায়। রঞ্জনের
মতো যৌবন থাকলে
ছাড়া রেখেই সে
নন্দিনীকে বাঁধতে পারতো।
বাঁধনের
রশিতে গিট দিতে
দিতেই তার সময়
গেল।
সব কিছুকেই সে
বাঁধতে পারে, অথচ
আনন্দকে বাঁধতে পারে
না।
তাইতো নন্দিনীর মতো
একটা ঘাসের দিকে
হাত বাড়িয়ে বলেছে- ‘’তৃষ্ঞার
দাহে এই মরুটা
কত উর্বরা ভূমিকে
লেহন করে নিয়েছে, তাতে
মরুর পরিসরই বেড়েছে- কিন্তু
এই একটু খানি
দূর্বল ঘাসের মধ্যে
যে প্রাণ তাকে
আপন করতে পারছে
না।’’
রাজা
নন্দিনীর মধ্যে দেখতে
পায়- বিশ্বের বাঁশিতে
নাচের যে ছন্দ
বাজে সেই ছন্দ।সেই নাচের ছন্দে
নন্দিনী অমন সহজ
হয়েছে।
অথচ এই ছন্দ, এই সুসঙ্গতিই রাজার
রুদ্ধ হয়ে আছে। তার প্রকৃত অন্তরতম
সত্তা বিধাতা যেন
রুদ্ধ করে রেখেছে। বিধাতার
সেই বদ্ধমুঠো রাজা
খুলতে সচেষ্ট। নিজের প্রকৃত
সত্তাকে সে বাহির
করবেই-এটাই তার
সংকল্প।
নন্দিনীর
আবির্ভাবে অন্তদ্বন্দ্বের সৃষ্টি। তার নিজের
বিরুদ্বে নিজেরই বিদ্রোহ। নিজের
এক সত্তার সাথে
অন্য সত্তা দ্বন্দ্ব
ক্রমে এই দ্বন্দ্বের
তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। একদিকে
শক্তির হৃদয়হীন অভিযান, বৃদ্ধির
অনুশীলনদীপ্ত শক্তির দপ্ত, নৈত্যের
মতো দীর্ঘদিন বাঁচবার
আকাঙ্ক্ষা, ইন্দ্রিয়দ্বারে সমস্ত কিছু
জানবার ও বুঝবার
প্রেরণা, উদ্দেশ্যহীন অপরিমেয়
সঞ্চয়ের লালসা-অপরদিকে
প্রাণের লীলা, সৌন্দয
ও প্রেমের দম্ভহীন সবজয়ী শক্তি আকাশের
আলো, বাতাসের গান, সুদুরের আকাঙ্ক্ষা, জীবনে যা কিছু মধুর, কোমল অনির্বচনীয়, হূয়দবঞ্জন,
সেই সহজ আনন্দের আকর্ষণ। এই দ্বন্দ্বের নানা অভিব্যক্তি-
রাজা নন্দিনীকে জানতে চায়। পুঁথিতে যা আছে রাজা
সব জানে, কিন্তু নন্দিনীকে জানে না। রাজা জানতে চায় রঞ্জনের ভালোভাসার স্বরূপ। নন্দিনী
জানায় জালের ভেতরকার হাল যেমন আকাশের উপরকার পালকে ভালোবাসে পালে লাগে বাতাসের গান,
আর হালে লাগে ঢেউয়ের নাচ। রাজার জবাবে নন্দিনী যখন বলে এক্ষুনি রঞ্জনের জন্য সে প্রাণ
দিতে পারে, তখন রাজা খুব রেগে যায়। মূলত সৌন্দয যে হাতে ধরা যায় না, কেবর হুদয় দিয়ে
অনুভব করতে হয়,আর প্রেমও যে এক অনির্বচনীয় অনুভূতি এবং এমন একটা জিনিস, যার জন্য আত্মবিসর্জন
অতি সহজ- এ বিষয়টি রাজা বুঝতে পারে না, অথচ প্রেমের প্রবল আকর্ষণ অনুভব করে-দ্বন্দ্ব
এখানেই।
রঞ্জন যে নন্দিনির প্রেমের পা্ত্র এবং উভয়েই যে
সেই প্রেমে ধন্য, এটিই রাজার বঞ্চিত হুয়দয়ে কাঁটার মতো বিদ্ধ করে, তাই রঞ্জনের উপর
তার ঈর্ষা। আবার এক মুহূর্তে সে পূর্ববস্থায় ফিরে যায়- নন্দিনীকে বের হয়ে যেতে বলে।
এই দ্বন্দ্ব, এই দেবদানবের যুদ্ধ রাজার মনে ক্রমেই তীব্রতর হয়।
যে ব্যাঙটি তিন হাজার বছর ধরে পাথরের আড়াল থেকে
টিকে থাকা শেখাচ্ছিল, আজ সে ব্যাঙকে পাথরের পাথর থেকে এনে রাজা তাকে মুক্ত করে দিল।
রাজা নন্দিনীর অলকের থেকে যে রক্তকরবীর গুচ্ছ গালের কাছে নেমে পড়েছে সেটি নন্দিনীর
কাছে চেয়ে বসে। রাজা ওই ফুলের গুচ্ছ দেখে আর তার মনে হয়, ও যেন তারই রক্ত আলোর শনিগ্রহ
ফুলের স্তূপ ধরে এসেছে। কখনো হাজার ইচ্ছে হয় নন্দিনীর কাছ থেকে ফুলের গুচ্ছ কেড়ে নিয়ে
ছিঁড়ে ফেলে, আবার ভাবে, নন্দিনী যদি কোনোদিন নিজের হাতে ওই মঞ্জরি রাজার গলে পরিয়ে
দেয়- রাজার এখানেও দ্বন্দ্ব। নন্দিনী যে রঞ্জনের জন্য প্রতীরক্ষা করে রাজার তা ভালো
লাগে না, সে রঞ্জনকে ধুলোর সাথে মিশে ফেলার কথা বলে। রাজা হয় ফুলের গুচ্ছ পাবে, না
হয় নষ্ট করবে।
এই আকর্ষণ-বিকর্ষণের পালায় রাজা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত,
তাই সৌন্দয মাধুযের মধ্যে একেবারে ডুবে তার পশুসত্তার মৃত্যুর হুমকি দেয়। নন্দিনী নির্ভয়,
কারণ মুহূর্তে নন্দিনীর মৃত্যু রাজাকে মারবে। কারণ নন্দিনীর প্রধান অস্ত্র হচ্ছে মৃত্যু।
শেষে রাজা আহ্বান করে নন্দিনীকে লড়াইয়ে- সে লড়াই
রাজার বিরদ্ধে নন্দিনীর, তবে রাজার হাতে হাত রেখে রাজার বিরুদ্ধেই তাকে লড়তে হবে। রাজার
হাতের মধ্যে নন্দিনীর হাত রেখে রাজাকে নন্দিনী মারুক, সেই মৃত্যুতেই রাজার মুক্তি।
প্রলয় পথের দীপশিখা হিসেবে নন্দিনীকে গ্রহণ করে
রাজা এগিয়ে চলে।
রঞ্জনের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে এ নাটকে রাজা ও নন্দিনীর দ্বন্ব্বের নিরসন ঘটে। রাজা ফিরে পায় তার মুক্ত স্বরূপ- রাজার মুক্তিতেই দ্বন্বের অবসান ঘটে। আর এই দ্বন্দ্বের অবসানেই ‘রক্তকরবী’ নাটকের মূল সূএ।