যুক্তফ্রন্ট কখন গঠিত হয় ও যুক্ত ফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি

 যুক্তফ্রন্ট কখন গঠিত হয়  

যুক্তফ্রন্ট কখন গঠিত হয় ও যুক্ত ফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি


স্বাধীন পাকিস্তান শুরু থেকেই কেন্দ্রকে শক্তশালি করা হয় এবং প্রদেশের ওপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা হয়।১৯৪৭সালে বিট্রিশ  ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় পাকিস্তানের জন্ন হয়্ ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী পাকিস্তানে একটি গণপরিষদ তথা কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ এবং প্রত্যেক প্রদেশে এক কক্ষবিশিষ্ট আইন অনুযায়ী পাকিস্তানে একটি গণপরিষদ তথা কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ এবং প্রত্যেক প্রদেশে এক কক্ষবিশিষ্ট আইন পরিষদ গঠন করা হয়।কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্যগণ প্রাদেশিক আেইন পরিষদের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন।ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার কর্তৃক ১৯৫৪ সালের ১১ মার্চ পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘোষিত হলে,১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর মুসলিম লীগ বিরোধি রাজনৈতিক দলগুলো;যেমন-কৃষক-শ্রমিক পার্টিিআওয়ামী মুসলিম লীগ,নেজামে ইসলামী ইত্যাদি দল একত্রিত হয়ে যুক্তয়্রন্ট গঠন করে। পরবর্তীতে খেলাফত রবক্ষানী পার্টি ও গণতন্ত্রী দল যুক্ত্রেন্ট শরীক হয়্ িএভাবে যুক্তফ্রন্ট একটি নির্বাচনী জোটে একতাবদ্ধ হয়। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক ছিল‘নৌকা ‘। শেরেবাংলা এ.কে.ফজলুল হক,মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী,শেখ মুজিবুর রহমান ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন যুক্তফ্রন্টের প্রথম সারির নেতা।


যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি

যে নিম্মতম কর্মসূচির ভিওিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ঐ্ক্যবদ্ধভাবে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করে,তাই ঐতিহাসিক ২১ দফা কর্মসূচি ।যুক্তফ্রুন্ট নেতাগণ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ২১ দফা লিপিবদ্ধ করেন। ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য শ্রদ্ধাভরে তাদের কর্মসূচিতে ২১ টি দফা লিপিবদ্ধ করেন। এই কর্মসূটি ‘নির্বাচনী ইশতেহার’হিসেবে গৃহীত হয়। এ ২১ দফাভিওিক নির্বাচনী ইশতেহারের মুসাবিদা রচনা করেন আবুল মনসুর আহমদ। তৎকালীন পূর্ব বাংলার সামাজিক ,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্হায় প্রেক্ষিতে ২১ দফা কর্মসূচি ছিল এক সময়োচিত ও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। নিচে যুক্তফ্রুন্টের ২১ দফা কর্মসূচির বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করা হলো।

১. রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ঃ  

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে।

২. জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ও কর হ্রাস

বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্ধৃত জমি বিতরণ করা হবে।  উচ্চ হারে খাজনা ন্যায়সঙ্গতভাবে হ্রাস করা হবে এবং সার্টিফিকেট যোগে খাজনা আদায়ের প্রথা রহিত করা হবে।

৩. পাটের ন্যায্য মূল্য প্রদান

পাট ব্যাবসাকে জাতীয়করণ করার উদ্দেশ্যে তাকে পূর্ববঙ্গ সরকারে পরিচালনাধীনে আনয়ন করে পাট উৎপাকের উপযুক্ত মূল্য দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। লীগ মন্ত্রীসভার আমলে পাট কেলেতংকারি তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট সবার শাস্তির ব্যবস্থা ও তাদের অসুদুপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।

৪. কুটির শিল্পের ‍উন্নতি

কৃষি উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে ও সরকারি সাহায্যে সকল প্রকার কুটির হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন করা হবে।

৫. লবণ তৈরীর কারখানা স্থাপন

পূর্ববঙ্গের লবণ শিল্পের স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য সমুদ্র উপকূলে কুটির শিল্পের ও বৃৎ শিল্পের লবণ তৈরীর কাখানা স্থাপন করা হবে। মুরলিম লীগ মন্ত্রীসভার আমলে লবণ কেলেংকারি সম্পর্কে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তি র ব্যবস্থা করা হবে ও তাদের অসদুপায়ে অর্জিত যাবতীয় অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হবে।

৬. বাস্তহারাদের পুনর্বাসন

শিল্প ও কারিগরি শ্রেণির গরীব বাস্তুহারাদের কাজের আশু ব্যবস্থা করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।

৭. খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা

খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করে দেশকে বন্যা ও ‍দুর্ভিক্ষের কবল থেকে রক্ষার ব্যবস্থা করা হবে।

৮. খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণত ও শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা

পূর্ববঙ্গের বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত করে ও কৃষিকে আধুনিক যুগোপযোগী করে শিল্প ও খাদ্যে দেশকে স্ববলম্বী করা হবে।  আন্তর্জাতিক শ্রমসময়ের মূলনীতি অনুসারে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামািজক সর্বপ্রকার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে।

৯. বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন

দেশের সর্বত্র একযোগে প্রাথমিক ও অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন এবং শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হবে।

১০. শিক্ষার সংস্কার সাধন

শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কার্যকরী করে কেবল মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হবে। সরকারে ও বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহের বর্তমান ভোদাভেদ উঠিয়ে দিয়ে একই পর্যায়ভূক্ত করে  সব বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি সহায্যপুষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে। শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হবে।

১১. বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্বশাসন প্রদান

ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল কানুন বাতিল ও রহিত করে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে উচ্চশিক্ষাকে সস্তা ও সহজলভ্য করা হবে। ছাত্রাবাসের অল্প ব্যয়সাধ্য ও সুবিধাজনক বন্দোবস্ত করা হবে।

১২.আয়ের সামঞ্জস্য বিধানঃ

 শাসন ব্যয় সর্বাত্নকভাবে হ্রাস করা হবে। এ উদ্দেশ্য উচ্চ বেতনভোগীদের বেতন কমিয়ে নিম্ম বেতনভোগীদের বেতন কমিয়ে নিম্ম বেতনভোগীদের বেতন বাড়িয়ে তাদের আয়ের একটি সুসঙ্গত সামঞ্জস্য বিধান করা হবে। যুক্তফ্রেন্টের কোন মন্ত্রী এক হাজার টাকার বেশী বেতন গ্রহণ করবেন না। 

১৩.আয় -ব্যয়ের হিসাব 

দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি ,ঘুষ-রিশওয়াত বদ্ধ করার কার্যকারী ব্যবস্হা করা হবে।এ উদ্দেশ্য সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি পদাধিকারী ও ব্যবসায়ীর ১৯৪০ সাল থেকে বর্তমান সময়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব নেয়া হবে এবং সন্তোষজনক কৈফিয়ত দিতে না পারলে তাদের সম্পওি বাজেয়াপ্ত করা হবে।

১৪.কালাকানুন রহিত

জননিরাপওা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালাকানুন রদ ও রহিত করে বিনা বিচারে আটক বন্দীকে মুক্তি দেয়া হবে। রাস্ষ্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার করা হবে। সংবাদপএ ও সভা সমিতির অধিকার াবাধ ও নিরষ্কুশ করা হবে।

১৫.বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করা হবে।

১৬.বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত

যুক্তফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী হাউসের পরিবর্ত অপেক্ষাকৃত কম বিরাসবহুল বাড়িতে বাসস্হান নিদিষ্ট করবেন। বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাএবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হবে।

১৭.শহীদ মিনার নির্মাণ

বাংলা রাষ্ট্রভাসার দাবিতে যারা মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভার গুলিতে শহিদ হয়েছেন,তাদের পবিএ স্মৃতি চিহুস্বরূপ ঘটনাস্হলে ‘শহীদ মিনার’নির্মাণ এবং তাদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।

১৮.শহীদ দিবস ও সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা

২১ ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস ঘোষণা করে একে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হবে।

১৯.পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসন ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা

লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন ও সার্বভৌমত্ব দেয়া হবে। দেশরক্ষা ,পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ছাড়া অন্য সব বিষয়(অবশিষ্ট ক্ষমতা)পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে আনয়ন করা হবে। দেশরক্ষা বিভাগের স্হরবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে ও নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্হাপন করা হবে। পূর্বে পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণের কারকানা নির্মাণ করে পূর্বে পাকিস্তানকে আত্নরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা  হবে। আনসার বাহিনীকে স্বশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হবে।

২০.মন্ত্রীসভার পদত্যাগ

যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভা কোন অজুহাতেই আইন পরিষদের আয়ু বাড়াবে না। আইন পরিষদের আয়ু শেষ হবার ছয় মাস আগেই মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে নির্বাচন কমিশনের মারফত স্বাধীন ও নিরপেক্স নির্বাচনের ব্যবস্হা করবেন।

২১.উপনির্বাচনের ব্যবস্হা

যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভার আমলে যখন যে আসন শূন্য হবে,তিন মাসের মধ্যে তা পূরণের জন্য উপনির্বাচনের ব্যবস্হা করা হবে। পরপর তিনটি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মনোনিত প্রার্থী পরাজিত হলে মন্ত্রীসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।
সুতরাং পরিশেষে বলা যায় যে,যুক্তফ্রন্টের উপর্যুক্ত ২১ কর্মসূচি তথা নির্বাচনী ইশতেহারে যে পরিকল্পনা গৃহীত হয়,তা ছিল ব্যাপক ও বাস্তববিত্তিক। তৎকালীন পূর্ব বাংলার সামাজিক ,অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্হার প্রেক্ষিতে  এ কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল। এ কর্মসূচিতে পূর্ব বাংলার কৃষি,শিক্ষা,শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চত করার যেমন আশ্বাস ছিল তেমনই ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি।রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে,সেই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা,২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘোষণা ও শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়। এই কর্মসূচিতে পূর্ব বাংলার জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি উথাপিত হয়। এভাবে যুক্তফ্রুন্টের পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের উপর বিশেষ জোর দেয়া হয়। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post